ক্রিকেট আবিষ্কারের পর থেকে একের পর এক বিতর্ক লেগেই ছিল এবং সময়ের সাথে যার পরিমাণ বাড়তেই থাকে। ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিতর্ক এবং সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছিল বোলারদের ‘চাকিং’ বোলিংয়ের অভিযোগ ।
এর শিকার হওয়া খেলোয়াড়রা পরীক্ষার মাধ্যমে কেউ নিজেদের উপর আনা অভিযোগ ভুল প্রমাণ করেছেন। অন্যদিকে কেউ নিজেকে শুধরাতে না পেরে বোলিং স্টাইল পরিবর্তন করে নিজের ক্যারিয়ার একেবারে জলাঞ্জলি দিয়েছেন ।
অনেকেই মনে করে যাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয় তারা চাকিংয়ের সাহায্যে একটু অতিরিক্ত সুবিধা পান। যুগে যুগে অনেক রথী-মহারথী এই চাকিংয়ের অভিযোগে শাস্তি পেয়েছেন । উনিশ শতকের আশির দশকে কাউন্টি ক্রিকেটে বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারের বোলিং অ্যাকশন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল।
তাদের মধ্যে সবার আগে নাম করতে হয় ল্যাংকাশায়ারের পেস জুটি জ্যাক ক্রসল্যান্ড আর জর্জ ন্যাশের। কেন্টের হয়ে তাঁদের বিপক্ষে খেলতে গিয়ে লর্ড হ্যারিস প্রথম তুলেছিলেন এ প্রশ্ন । তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে কেন্ট আর ফিরতি ম্যাচে আতিথ্য দেয়নি ল্যাংকাশায়ারকে।
এর পরের ‘অপরাধী’ আর্নেস্ট জোনস , যদিও তা নিয়ে বহু মতভেদ রয়েছে । তবে জোনসকে সত্যিকারের ‘অভিযুক্ত’ করেছিলেন একজন অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার জিম ফিলিপস । ১৮৯৭ সালের মেলবোর্ন টেস্টে চাকিংয়ের অপরাধে জোন্সকে নো ডেকেছিলেন তিনি। চাকিং বিষয়ে দারুণ কড়া ছিলেন এই ফিলিপস , শুধু জোন্সকেই নয় নো ডেকে তিনি বোলিং ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছিলেন সি বি ফ্রাইয়েরও ।
প্রতি দশকে এই অভিযোগে সাময়িক তোলপাড় সৃষ্টি হলেও আস্তে আস্তে তা থেমে যায়। নব্বইয়ের দশকে চাকিং নতুনকরে বিতর্ক সৃষ্টিকরে । ১৯৯৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার বক্সিং ডে টেস্টে আম্পায়ার ডেরেল হেয়ার অফস্পিনার মুরালিধরনের বিরুদ্ধে চাকিংয়ের অভিযোগ তুলে নো বল ডাকে। যা নিয়ে আম্পায়ারের সাথে লংকান অধিনায়ক রানাতুঙ্গার অনেকক্ষন তর্ক-বিতর্ক চলে , এবং একপর্যায়ে পুরো শ্রীলঙ্কা দল মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চায় ।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতাকামী সংগঠন “এলটিটিই” হেয়ারকে মৃত্যুর হুমকি পর্যন্ত দেয় । শেষপর্যন্ত শ্রীলঙ্কান বোর্ডের শর্তে হেয়ার শ্রীলঙ্কার আর কোন ম্যাচেই আম্পায়ারিংয়ের সুযোগ পাননি । আস্তে আস্তে চাকিংয়ের তালিকায় নাম উঠে শোয়েব আখতার , ব্রেট লি , হরভজন সিং , সাঈদ আজমল , ইয়োহান বোথা , মারলন স্যামুয়েলস , শাব্বির আহমেদ, সোহাগ গাজী , তাসকিন ,আরাফাত সানি , আল-আমিন হোসেন, সচিত্রা সেনানায়েক ,মোহাম্মদ হাফিজ, মালিঙ্গা , নারাইনের মত বোলাররা ।
চাকিং অভিযোগে সবচেয়ে বেশি অফস্পিনাররাই সাধারণত ভুক্তভোগী হচ্ছেন। কোন ম্যাচে বোলার বল ছাড়ার ঠিক পূর্বমূহুর্তে (অর্থাৎ বলটা ডেলিভারির মূহুর্তে) যদি বোলারের বোলিং হ্যান্ডের (যে হাতে বোলার বল করে) কনুই যদি ১৫° র বেশী ভেঙে যায় তাহলে এই ধরনের বোলিং অ্যাকশনকে চাকিং অ্যাকশন বলে।
ক্রিকেটের আইন অনুযায়ী এই ধরনের বোলিং অ্যাকশনকে অবৈধ বলে ধরা হয় এবং কোনও বোলার যদি এধরণের বল ডেলিভারি করে ফেলে এবং সেটা যদি আম্পায়ারের চোখে ধরা পড়ে তবে তার সেই ডেলিভারিটাকে অবৈধ বলে গন্য করে নো-বল ডাকা হয় । সাধারণত দুসরা ডেলিভারি দেয়ার সময়ই এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
চাকিং নিয়ে বিতর্কটার যেন শেষ নেই । কোনো ক্রিকেটার এই অভিযোগে অভিযুক্ত হলেই সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়ের দেশ এবং ক্রিকেটপ্রেমীরা এতে কোনো না কোনো ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে যান । নব্বইয়ের দশকে ইংল্যান্ডে একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় যে আসলে বোলিংয়ের সময় কনুই একেবারেই সোজা না করা সম্ভব নয় , সব বোলাররাই এটা করে থাকেন কিন্তু খালি চোখে তা দেখা যায় না।
এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে ঠিক করা হয় ফাস্ট বোলারদের জন্য ১০ ডিগ্রি, মিডিয়াম পেসারদের জন্য ৭.৫ ডিগ্রি আর স্পিনারদের জন্য ৫ ডিগ্রি পর্যন্ত সহনশীলতার মাত্রা। নানা রকম বায়োমেকানিকাল পরীক্ষার মাধ্যমে এই মাত্রাটি ল্যাবরেটরিতে নির্ধারণ করার ব্যবস্থা করা হয় । মুত্তিয়া মুরালিধরনই হচ্ছেন প্রথম বোলার যিনি এই পরীক্ষাটি দেন আইসিসির অনুমোদিত অস্ট্রেলিয়ান ল্যাবরেটরিতে। কিন্তু এরপরও বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না । শেষপর্যন্ত ২০০৪ সালে আইসিসি নতুন এক সিদ্ধান্ত নেয় ।
সিদ্ধান্তনুযায়ী সব বোলারদের জন্য সহনশীলতার নতুন এক নির্দিষ্ট মাত্রা ঠিক করে দিল এবং তা হচ্ছে ১৫ ডিগ্রী । নতুন এই সিদ্ধান্তে শোয়েব , হরভজন , আজমলসহ অনেক বোলার বায়োমেকানিকাল পরীক্ষা দিয়ে তারপর নিজেদের উপর নিষেধাজ্ঞার অভিযোগ ভুল প্রমাণ করেন । এদের মধ্যে কেউ সঠিকভাবেই পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যান আর কেউ পরিক্ষার বৈতরণী পার করতে বিফল হয়ে নিজের বোলিং স্টাইল চেঞ্জ করতে বাধ্য হন।
তার ফলশ্রুতিতে অনেকরই নিজের গোপন অস্ত্র এবং বোলিংয়ের ক্ষুরধার খেই হারিয়ে থুবড়ে পড়ে । শুধু বোলিং নয় বরং অনেকের ক্যারিয়ারটাই থেমে যায় অদ্ভুত এই চাকিং সমস্যার জন্যে । চাকিং নামক এই অভিযোগে আর কতজন খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারটি অকালে ঝরে পড়বে কে জানে । তখন হয়তোবা আইসিসি আবারো নতুন কোন নিয়ম ঘোষণা করে উপস্থিত হবে ত্রাতার ভূমিকায় ।
Comments