সায়ন্তন ভট্টাচার্য্য: আসুন, আপনাদের আজ আমাদের কোহিনূরের গল্প শোনাই। কী ভাবছেন? কোহিনূর তো সেই কবেই বৃটিশরা চুরি করে নিয়েছে, আমি কোহিনূর কোথায় পেলাম?
আছে! আমাদেরও খুব আপন একটা কোহিনূর আছে। আছে অমূল্য সেই হীরা। এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না? তাহলে তো কষ্ট করে নিচের গল্পটুকু পড়তেই হয়। আশা করি পড়তে পড়তে জেনে যাবেন আমাদের খুব নিজের, জীবন্ত কোহিনূরের রোশনাই, আলোর কথা।
প্রায় বছরখানেক আগে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে ভারতে আসি। বেশ কয়েক বছরের জন্য আমার ঠিকানা পাঞ্জাব প্রদেশ৷ পাঞ্জাবের মফস্বল শহর ফাগোয়ারায় আমার ছোট্ট নীড়। এখানকার একটা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্যই এতদূর হতে আসা।
প্রথম ক্লাস। একে তো বিদেশি, এর ওপর আমি নতুন ছাত্র। অচেনা, অজানা সমুদ্রে পড়লাম। কেউই চিনতে পারেনি। সেটাই স্বাভাবিক। কেউ আগ্রহও দেখাল না।
দ্বিতীয় দিনের ক্লাস। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের একটা জার্সি পরে হাজির আমি। তখন থেকেই মূল ঘটনা শুরু। ক্লাসে রোল নম্বর অনুযায়ী বসার নিয়ম। যথারীতি আমি আমার স্থানে বসলাম এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লেকচারার ঢুকলেন। রোল কল শুরু করলেন এবং আমি উপস্থিত আছি, এটা জানানোর পর থেমে গেলেন।
আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন(ইংরেজিতে) আমি কোথা থেকে এসেছি। আমি বললাম ‘বাংলাদেশ’।
আরও পড়ুনঃ পরিসংখ্যানের পাতায় সাকিবের শ্রেষ্ঠত্ব
সাথে সাথেই ক্লাসের ৫০ জন ছাত্রছাত্রী একযোগে আমাকে দেখতে লাগলো, যেন আমি ভিনগ্রহের কোনো বাসিন্দা। ওরা ভাবতেই পারেনি, ওদের মত দেখতে একজন মানুষ সম্পূর্ণ আলাদা একটা দেশেরও হতে পারে। কারণ বাংলাদেশ-ভারত; দুই দেশের মানুষের মধ্যে বর্ণ, আকার, দৈহিক গড়নের বেশ সাদৃশ্য আছে।
আমার পাশের জন, বাড়ি কেরালায়। যেখানে ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবলটাই জনপ্রিয়। তার
জিজ্ঞাসা, আমি হিন্দি জানি কি না।
উত্তরে বললাম, ‘অল্প অল্প জানি’।
এরপরের প্রশ্ন, ‘তুমি সাকিব আল হাসান কে চেনো?’
প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে আমার প্রশ্ন মিশ্রিত উত্তর, ‘কেন চিনব না?’
‘মুস্তাফিজুর রহমানকে চেনো?’, প্রশ্ন শুনে ভাবলাম ব্যাটাকে এবার ক্রিকেট জ্ঞানের পরিধিটা বোঝাই।
‘আমি মোটামুটি গত ১০-১৫ বছরে যারা যারা আমার দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলেছে সবাইকে চিনি’, উত্তর শুনে কেরালার ছেলেটার গলায় সাকিবের প্রশংসার সুর, ‘সাকিব আল হাসান একটা ডায়মন্ড ভাই।’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ,ও আমাদের দেশের কোহিনূর।’
আরও পড়ুনঃ রুবেল ডানা মেলেছিলেন, আমরাও…
ক্লাসে এত কথা বললে ধরা তো পড়তে হবেই। আমরাও ধরা পড়লাম। স্যার আমাদের দুইজনকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী নিয়ে আলাপ করছি। আমি কিছু বলার আগেই কেরালার ছেলেটা বলে, ‘স্যার, আমরা বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে আলাপ করছিলাম।’
স্যারও আমাকে অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি সাকিব আল হাসানকে চেনো?’
আমার হ্যাঁ বোধক উত্তর পেয়ে স্যারের দ্বিতীয় প্রশ্ন, ‘ওকে কখনো সরাসরি দেখেছো?’
আমি বললাম,”হ্যাঁ স্যার,দেখেছি”।
এরপরের প্রশ্ন,”আচ্ছা সাকিবকে বিশ্বকাপে ম্যান অফ দ্যা টুর্নামেন্ট দেয়া হলোনা,তোমাদের রাগ হয়নি?”
আমি বললাম ‘স্যার, রাগ হয়নি,তবে মন খারাপ হয়েছে। তাছাড়া কেন উইলিয়ামসনও এই সম্মান ডিজার্ভ করে সাকিবের মতোই।’
স্যার বললেন, ‘তোমাদের মন অনেক বড়,তোমরা জানো যে তোমাদের সাকিব আসলেই বিশ্বসেরা এইসব ট্রফি ছাড়াই। আমাদের দেশে আইসিসি কে নিয়ে ট্রলের বন্যা হয়ে গেছে রোহিত শর্মা কে না দেয়ায়।’
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু এরপরের কথাগুলো জানানোর লোভ সামলাতে পারছিনা। গল্পে ফিরে যাই।
স্যারের কথা শুনে ঠিক ওই সময়টায় আমি মনে মনে নিজের কাছেই অনেক ছোট হয়ে গেলাম।ভাবলাম, স্যারের মতো অনেকেই আছেন, যারা প্লেয়ারের দেশ দেখে নয়, ট্যালেন্ট দেখে সম্মান করেন, তারা যখন জানবেন আমরা আমাদের কোহিনূরকে কীভাবে মর্যাদা দিই, মূল্যায়ন করি, কীভাবে তার পুরো পরিবারটা আমাদের আঙ্গুলের ডগায় এসে লজ্জায় অবনত হয়ে থাকে আমাদের ট্রলের ভয়ে, তখন ঠিকই কষ্ট পাবেন তারা।
‘আমাদের দুই দেশ একই হলে আমাদেরও একটা সাকিব আল হাসান থাকতো।’, বিশ্বাস করুন, স্যারের মুখে এই কথা শোনার পর আমার বুকটা গর্বে ভরে উঠেছিল।
আরও পড়ুনঃ সাকিব: দ্য ফ্লোড জিনিয়াস
আমাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী একটা দেশের একজন ক্রিকেটভক্তের এই আকুতিতে। মনে মনে শুধু ভাবছি,আমাদের দেশটা সেই একাত্তরে স্বাধীন না হলে আমরা হয়তো এমন একটা রত্ন আমাদের একান্ত নিজেদের বলে গর্ব করতে পারতাম না কখনোই। এরপর স্যার বললেন, দেশে গেলে যেন সাকিব আল হাসানের একটা অটোগ্রাফ নিয়ে আসি, বিনিময়ে উনি আমাকে ওনার কালেকশনে থাকা শচীন টেন্ডুলকারের অটোগ্রাফ দেবেন।
ক্লাসের বাকি আর ৪০ মিনিট, স্যার তখন ক্লাসের সবাইকে বললেন, ‘তোমরা কে কে সাকিব আল হাসান কে চেনো?’
উত্তরে একটা হাতও উঠতে বাকি ছিল না। এক চাইনিজ ছেলে বলল সাকিব যখন চায়না গিয়েছিল, তখন সে সাকিবের সাথে সেলফি নিয়েছে এবং সাকিব তাকে অটোগ্রাফ দিয়েছে। সেদিন আর ক্লাস হয়নি, শুধু বিশ্বকাপ, সাকিব, মুস্তাফিজ আর ভারত নিয়েই আলোচনা হল।
যদিও আমার কানে এসব আলোচনা অতটা আসছিল না। শুধু ভাবছিলাম আমাদের ক্রিকেটে সাকিবের অবদানের কথা৷
অনেকেই আগে বাংলাদেশ মানে পদ্মার ইলিশ, আর সুন্দরবন ই বুঝত। এখন বাংলাদেশ মানে সুন্দরবন নয়, বাংলাদেশ মানে কক্সবাজার নয়,বাংলাদেশ মানে পদ্মার ইলিশ নয়, বাংলাদেশ মানে একজন সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশ মানে সাকিব নামের অমূল্য কোহিনূর।
জেটি
Comments