সিফাত হাছান সুমাইয়াঃ একটা সময় রাতে ঘুমের মধ্যে আমি প্রায়ই মিরপুর স্টেডিয়াম চলে যেতাম। সেখানে গিয়ে আমি রোজ খেলা দেখতাম, অনেক চিৎকার করতাম আর খেলা শেষে একজন ক্রিকেটারের সঙ্গে কথা বলতে চাইতাম, আড্ডা দিতে চাইতাম। সে সময়টা বেশিদিন আগের না। আজ থেকে প্রায় ৫-৬ বছর আগের কথা। তখন আমি কলেজের শিক্ষার্থী।
ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি একধরনের ভালবাসা নিয়ে বড় হয়ে উঠা আমি যখন কলেজে উঠলাম, তখন আমার দুনিয়াই ছিল ক্রিকেট। এ খেলার জগতের সবাই ছিল আমার প্রিয়। তবে সবার ভিড়ে একজনকে নিয়ে ছিল বাড়াবাড়ি রকমের পাগলামি। আশেপাশের সবাইকে ব্যস্ত করে তুলতাম আমার পাগলামিতে। আর পাগলামির সঙ্গী ছিল আমার প্রিয় বান্ধবী। যাকে নিয়ে পাগলামি সেই ক্রিকেটার হচ্ছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের বর্তমান টেস্ট ক্যাপ্টেন মুমিনুল হক সৌরভ।
ঐ সময়টায় পড়ালেখার বাইরে সারাক্ষণ মেতে থাকতাম এই পাগলামিতে। মুমিনুলের ছবিসহ পেপার কেনা আর সেই ছবি কেটে ডায়েরিতে লাগিয়ে রাখা কিংবা ইন্টারনেট থেকে তার ছবি ডাউনলোড ছিল আমার প্রধান কাজ। কিন্তু এত কিছু করলেই বা কী? দেখা তো পেতে হবে। যে করেই হোক মুমিনুলের সঙ্গে আমার দেখা করতে হবে, কথা বলতে হবে, একটা অটোগ্রাফ তো আমার চাই-ই চাই।
আশাহত প্রথম যাত্রা
তখন নানাবিধ কারণে আমার পক্ষে মিরপুর স্টেডিয়াম যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই দেখা করার জন্য আমার আর আমার বান্ধবীর প্ল্যানে ছিল নিজের এলাকার ফতুল্লা স্টেডিয়াম। কিন্তু সমস্যা এখানেই! ফতুল্লা স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ম্যাচ একদম হয় না বললেই চলে। তাই চোখ রাখতে হবে প্রিমিয়ার লিগের দিকে।
যেই ভাবা সেই কাজ। কলেজ ইউনিফর্মেই একদিন চার বান্ধবী চলে গেলাম ফতুল্লা স্টেডিয়াম। এবার আসল ব্যাপার। দর্শকসারি নয়, দেখা করে কথা বলতে হলে যেতে হবে আমাদের ভিআইপি গ্যালারির দিকে। কিন্তু বললেই তো হয় না! চারজন কলেজ ইউনিফর্ম পরা মেয়েকে গ্যালারি তো দূর, গেট দিয়েই ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না।
দুপুরের রোদে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম এবার কী করা যায়? ফিরে যাব নাকি অন্য কোন চেষ্টা করব? ভাবতে ভাবতে আমাদের সামনে মোটরবাইক থেকে দুজন মানুষ এসে থামলেন। তাদের দেখে আমরা যতটা ভয় পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি তারা অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, এভাবে আমরা চারজন এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছি। সাহস করে তাদের বলে দিলাম, আমাদের দাঁড়িয়ে থাকার আসল কারণ। সব শুনে একজন বললেন, এভাবে কি দেখা করা সম্ভব? আমি বললাম, চেষ্টা করে দেখি যদি পারি।
আরও পড়ুনঃ স্বপ্ন ছোঁয়ার দিন
এ কথায় তিনি বললেন, আচ্ছা ভেতরে যাও। গিয়ে বলবে আমার নাম (আমরা আক্তার ভাইয়ের লোক)। বললে ঢুকতে পারবে কিন্তু দেখা কীভাবে করবে নিজেরা জানো। ঐ জায়গায় কোন সাহায্য নেই। আমরা হাঁসি দিয়ে ধন্যবাদ বলতে বলতে দিলাম এক দৌড়। জায়গামত আক্তার ভাইয়ের নাম বলে ঢুকে গেলাম ভেতরে। আজও জানি না আক্তার ভাই আসলে কে ছিলেন?
জীবনের প্রথম ঢুকলাম স্টেডিয়ামে। প্রিমিয়ার লিগ বলে তেমন দর্শক ছিল না গ্যালারিতে। কিন্তু নিজের চোখে প্রথম দেখছি বোলার বল করছে, ব্যাটসম্যান রান নিচ্ছে আর ফিল্ডার রান বাঁচাতে মাঠে ছুটে বেড়াচ্ছে। সেই অনুভূতি! কোনকিছুর সঙ্গে তার তুলনা হয় না। অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। বেশ কিছু সময় পর জানতে পারলাম ঐদিন মুমিনুলদের খেলা ছিল না। মন খারাপ হলেও প্রথমবার স্টেডিয়ামে যাওয়া আর কাছ থেকে খেলোয়াড়দের দেখতে পারার অভিজ্ঞতা খারাপ ছিল না। বাকিরা অনেক খুশি ছিল, আমি আমার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পেরে এক ধরনের আক্ষেপ নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরে যাই।
এবার হবে স্বপ্ন সত্যি
মনের মধ্যে ইচ্ছার জোর যখন অনেক বেশি থাকে, আল্লাহ ঠিক একটা ব্যবস্থা করে দেন। দুই-তিনদিন পর এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পেলাম, আগামী শুক্রবার মুমিনুলের দলের খেলা আছে। শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ শুক্রবারে তো বাসা থেকে তো বের হওয়া সম্ভব নয়। আর ঐদিন যাবোই বা কার সঙ্গে। সেই মনের দুঃখ জানালাম আমার বান্ধবীকে। সে উত্তরে বলল, একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই…
আসলে ব্যবস্থা সে নিজেই করে দিলো। শুক্রবার দুপুরে আমাকে ফোন করে জানাল, যাওয়ার ইচ্ছে থাকলে আমি যেন এখনই রওনা দিয়ে দেই, কারণ সুমির (বান্ধবী) বাসা থেকে ওর ভাবি আমাদের স্টেডিয়াম নিয়ে যাবেন। মনের ভেতর অনেক শান্তি লাগছিল। কিন্তু বাসা ভরা অনেক মেহমান, ফলে বাসায় জানাতে সাহস পাচ্ছিলাম না। তাও আম্মুকে যখন বললাম, তখন আম্মু আমার অবস্থা বুঝতে পারলেন। বললেন আচ্ছা যা! মেহমানদের সামনে গিয়ে বললেন, একটা জরুরি দরকারে আমাকে এখনই এক জায়গায় যেতে হবে। আমি তো খুশিতে আটখানা।
আরও পড়ুনঃ পোর্ট অব স্পেন: সুখের পরশপাথর
০২ জানুয়ারি ২০১৫। বিকেল ৪টার দিকে আমরা ৬জন গেলাম ফতুল্লা স্টেডিয়াম। খেলা প্রায় শেষের দিকে, কিন্তু সেদিন আর আক্তার ভাইয়ের পরিচয়ে ঢুকতে পারছিলাম না। আরও একবার ভাবলাম, তাইলে কি এবারও? কিন্তু সেদিন শুক্রবার হওয়ায় স্থানীয় অনেক ছেলেরা বিকেলে স্টেডিয়াম গিয়েছিল। সবার জোরাজুরিতে কিছুক্ষণ পর ঢুকতে পারলাম। গ্যালারিতে বসে সবার আগে যার দিকে চোখ পড়েছিল, তিনি ছিলেন আমার সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি, মুমিনুল হক সৌরভ।
আমি গ্যালারিতে বসামাত্রই তার অর্ধশতক পূরণ হয়। দূর থেকে আমি ঠিকই চিনতে পেরেছিলাম। পঞ্চাশ করার পর আমি মনে মনে ভাবলাম, এবার আউট হয়ে গেলে আমি সামনে থেকে দেখতে পারব। ওমা! পরের বলে সত্যিই আউট। ধীর পায়ে ফিরছিলেন সাজঘরে আর আমার মধ্যে এক ধরনের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার অনুভূতি হচ্ছিল।
কাছ থেকে ‘স্বপ্ন’ দেখা
যখন একদমই আমার সামনে চলে এলেন, তখন সুমি আর ভাবি আমাকে বারবার করে বলছিলেন কথা বলতে। কিন্তু আমি একদম চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সত্যি বলতে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি ভাবছিলাম, আমি সত্যিই মুমিনুলকে দেখছি নাকি বিভ্রম। আমি তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুমিনুল উঠে ড্রেসিংরুমে চলে যান। যাওয়ার পরে সবার বকা খেয়ে বোকার মত করে উত্তর দিলাম, এই মাত্র আউট হয়ে এসেছে, কথা বলতে চাইলেই কি বলতো নাকি?
কিছুক্ষণ পরে খেলা শেষ হয়ে গেল। সব খেলোয়াড় নেমে আসে মাঠে, সঙ্গে মুমিনুলও। নাহ! এবার কথা বলতেই হবে। সামনে দিয়ে যাবার সময় ভাবি ডাক দিলেন, মুমিনুল ভাই বলে। ব্যস! দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে তাকালেন। স্বপ্ন বাস্তব হওয়ার এমন আনন্দঘন মুহূর্ত সত্যি বলতে জীবনে অনেক কমই আসে। ঐ সময় মুখে কোন কথা আসে না। সত্যি বলতে কোন কথা বলা উচিত নয়। শুধু সেই সময়টাকে উপভোগ করতে হয়। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মানুষের উত্তেজিত অবস্থায় হাত-পা যে সত্যিই কাঁপতে থাকে, আমি সেদিন প্রথমবার বুঝতে পারি।
সুমির ধমক খেয়ে আমার কাঁপুনি বন্ধ হয়। ও বলে, চুপ না থেকে কথা বল এবার। আমাকে দেখিয়ে সুমি নিজেই বলল, ভাইয়া, ও আপনার অনেক বড় ফ্যান। এ কথা শুনে মুমিনুলের মুখে স্বভাবসুলভ সারল্যমাখা হাসি। সত্যি ঐ সময়টা অনেক সুন্দর ছিল, সারাজীবন মনে রাখার মত। আমি বললাম, ভাইয়া একটা অটোগ্রাফ। আবারও হাসি মুখে বললেন, ঠিক আছে।
আমি তার দিকে খাতা-কলম বাড়িয়ে দিলাম। তিনি আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। নাম বলার পর নিচের দিকে তাকিয়ে লিখলেন। লেখা শেষ হওয়া পর আমি বললাম, ভাইয়া দাঁড়ান একটু, একটা ছবি তুলি। তিনি দাঁড়ালেন আর আমি আমার জীবনের অন্যতম সুন্দর ছবিটা তুলে নিলাম। তারপর ডায়েরিটা আমার হাতে দিয়ে চলে গেলেন ভেতরে। সবমিলিয়ে ঐ ৫ মিনিট সময়টা আমার কাছে অনেক দামি হয়ে রইল।
গ্যালারি থেকে বের হয়ে দাঁড়ালাম তার গাড়ির সামনে। কিছুক্ষণ পরে তিনি বের হয়ে গাড়িতে উঠলেন। আমি ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। হুট করে এক পিচ্চি হাত নেড়ে কথা বললে, মুমিনুল আবারও এক হাসি দেয়। পরে গাড়ি চালু হয় আর তিনি চলে যান ঢাকার অভিমুখে।
তখন প্রায় সন্ধ্যা। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবতে থাকি, আমার জীবনের অন্যতম এক সেরা বিকেলের মুহূর্ত। খুশিতে এবার আমার চোখে পানি চলে আসে! অবশেষে দেখা হয়েছে তাহলে!
[…] আরও পড়ুনঃ পড়ন্ত বিকেলে কাছ থেকে ‘স্বপ্ন’ দেখা […]
[…] আরও পড়ুনঃ পড়ন্ত বিকেলে কাছ থেকে ‘স্বপ্ন’ দেখা […]